জুলীয়াস চৌধুরী
বাংলাদেশে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যা জনগণকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। প্রতিদিনের খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের ফর্মুলা ও নীতি প্রয়োগ করেও কার্যকর সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কমলেও বাংলাদেশে কেন এ সমস্যার কোনো অবসান ঘটছে না, তা নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করবে কেন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না, কীভাবে অন্য দেশগুলো এ সমস্যার মোকাবিলা করছে, এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কার্যকর পন্থাগুলো কী হতে পারে।
ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশেও চাপ তৈরি হচ্ছে। ভারতে পণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশ আমদানিতে সমস্যায় পড়ে, বিশেষত খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে, তেমনি অভ্যন্তরীণ বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এভাবে, সঠিক নীতি গ্রহণ করলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যা জনগণকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। প্রতিদিনের খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের ফর্মুলা ও নীতি প্রয়োগ করেও কার্যকর সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কমলেও বাংলাদেশে কেন এ সমস্যার কোনো অবসান ঘটছে না, তা নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করবে কেন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না, কীভাবে অন্য দেশগুলো এ সমস্যার মোকাবিলা করছে, এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কার্যকর পন্থাগুলো কী হতে পারে।
মূল্যস্ফীতির অর্থনীতি: বাংলাদেশের বিশেষ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মূলত দুইটি প্রধান কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে: বৈশ্বিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। তবে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, মূল্যস্ফীতির অধিকাংশ কারণ অভ্যন্তরীণ। বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা এই সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে।বিশ্লেষকদের দৃষ্টিকোণ
আইএনএম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, "মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র সুদহার বাড়ানো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার্যকর নয়। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা কম। এর ফলে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নীতিগুলো দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।"শ্রীলঙ্কার থেকে শিক্ষা: সংকোচন বা ডিফ্লেশন
শ্রীলঙ্কা গত কয়েক বছরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২২ সালে দেশটি ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির শিকার হলেও ২০২৪ সালে তা কমে ঋণাত্মক দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এই ঘটনাকে মূল্য সংকোচন বা ডিফ্লেশন বলা হয়, যেখানে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। শ্রীলঙ্কা তাদের বৈদেশিক দায় পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া ঘোষণা করলেও, কঠোর অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিয়েছে।শ্রীলঙ্কার সফলতা
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকোচন মূলত তাদের সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি ও বৈদেশিক রিজার্ভ বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। অথচ, বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রগুলোতে তেমন অগ্রগতি করতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার মতো কঠোর আর্থিক নীতি না নিয়ে বাংলাদেশ বরং অতি ধীরে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।ভারত এবং পাকিস্তানের তুলনামূলক পরিস্থিতি
ভারত ও পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৫-৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। যদিও ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী, তাদের কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় শুল্ক আরোপ ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কাজ করছে। পাকিস্তানে, দীর্ঘদিনের দুই অংকের মূল্যস্ফীতি এখন ৬.৯ শতাংশে নেমে এসেছে।ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশেও চাপ তৈরি হচ্ছে। ভারতে পণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশ আমদানিতে সমস্যায় পড়ে, বিশেষত খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
কেন বাংলাদেশের নীতিগুলো ব্যর্থ?
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রধান সমস্যা হলো, সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নীতিগুলো প্রয়োগ করছে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে এনেছে, কিন্তু এর প্রভাব সীমিত। সাধারণ জনগণের আর্থিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ততা কম থাকায় সুদহারের পরিবর্তন সেভাবে কাজে লাগছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।বিশেষজ্ঞদের সমাধান
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং বাজারের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ বন্ধ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি, দেশে উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। দেশে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়ানো গেলে বিদেশ থেকে আমদানি কমে যাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও করণীয়
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যাপকভাবে কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে হতে পারে। আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বন্যার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ড. মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, "স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে পারলে আমদানির উপর নির্ভরতা কমে যাবে এবং বিদেশি বাজারে দাম বেড়লেও আমাদের দেশের পরিস্থিতি তেমন প্রভাবিত হবে না।"টেকসই সমাধানের পথে
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির সমস্যার একটি টেকসই সমাধান খুঁজতে হলে কেবল অর্থনৈতিক নীতিমালা পরিবর্তন নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার ব্যবস্থার বিপক্ষে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনো কার্যকর ফল আশা করা কঠিন। দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব।বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে, তেমনি অভ্যন্তরীণ বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এভাবে, সঠিক নীতি গ্রহণ করলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন: