পদ্মা সেতু নির্মাণে নিজস্ব অর্থায়ন: মুদ্রাবাজারে সংকট ও মূল্যস্ফীতি কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামাল

পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু
জুলীয়াস চৌধুরী

পদ্মা সেতু, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প, দেশের জন্য একটি মাইলফলক হলেও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দেশকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ সেতু প্রকল্পের পিছনে বিশাল অঙ্কের অর্থায়ন, যা স্থানীয় ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাবে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার সংকট দেখা দেয়। কীভাবে পদ্মা সেতুর জন্য নেয়া ঋণ, উচ্চ সুদ, এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার মুদ্রাবাজারে সংকট তৈরি করল এবং মূল্যস্ফীতি বাড়াল, তা নিয়ে এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।


পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক প্রভাব

পদ্মা সেতুর নির্মাণের জন্য সরকার প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগই সংগ্রহ করা হয় দেশীয় রিজার্ভ এবং স্থানীয় ব্যাংক থেকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিশাল চাপ পড়ে এবং এর ফলে দেশের রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগে ১.২ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়, তখন সরকারের নিজস্ব অর্থায়নই প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল।

বিশ্বব্যাংকের ঋণের জায়গায় সরকারকে উচ্চ সুদের হারে স্থানীয় মুদ্রায় ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে চাপে ফেলে দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা ছিল, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করবে। কিন্তু এর পরিণামে দেশীয় ব্যাংকিং খাত এবং মুদ্রাবাজারে সংকট দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে অর্থনীতির উপর।


নিজস্ব অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার

অগ্রণী ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করেছিল। প্রথমে ২০১৩ সালে ৬.২৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়, যার মূল্য ছিল ৭৭.৫০ টাকা প্রতি ডলার। কিন্তু ২০২১ সালের মধ্যে ব্যয়িত ডলারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৪ বিলিয়ন, এবং ডলারের মূল্য বেড়ে যায় ৮৮.৮০ টাকায়। মহামারির কারণে বৈদেশিক দায় পরিশোধ বন্ধ থাকায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২১ সালে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। তবে, আমদানি ও বৈদেশিক দায় পরিশোধ পুনরায় শুরু হলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয় দেশ। এই সময় ডলার সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে এবং রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।


ঋণ গ্রহণ ও উচ্চ সুদের প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল হওয়ার পর, সরকারকে স্থানীয় ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল। এতে করে সরকারের ঋণের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়, যার প্রভাব সরাসরি সাধারণ জনগণের উপর পড়ে। নির্মাণ খরচ বেশি হওয়ার কারণে পদ্মা সেতুর টোল ফি তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ধারণ করা হয়। এতে যানবাহনের মালিকদের জন্য বাড়তি ব্যয় তৈরি হয়, যা পরিবহন খাতের মাধ্যমে অন্যান্য পণ্য ও সেবার মূল্যস্ফীতিতে অবদান রাখে।

বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, মেগা প্রকল্পগুলিতে বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ থাকলে সাধারণত সুশাসন এবং প্রকল্পের খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে দাতা সংস্থাগুলোর অনুপস্থিতিতে প্রকল্পের ব্যয় অত্যন্ত বেড়ে যায়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, পদ্মা সেতুর স্ব-অর্থায়ন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যার ফলে আর্থিক চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বেশি পড়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য কম সুদে এবং নমনীয় শর্তে ঋণ নেয়া দরকার ছিল।


মুদ্রাবাজারে সংকটের কারণ

পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য ডলার সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ক্ষয় দেখা দেয়। বিশেষ করে, ২০২১–২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭.৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে, যা তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। ডলার বিক্রির ফলে দেশীয় মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যায়, যা মুদ্রাস্ফীতি উস্কে দেয়। মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং ডলারের দাম বাড়ার ফলে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, যার ফলে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। এটি সরাসরি দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে।


বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট

ডলার বিক্রি এবং বৈদেশিক দায় পরিশোধের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে। অথচ ২০২১ সালে তা ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ হ্রাসের কারণে দেশের বিনিয়োগ এবং আমদানি খাতে চরম সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে তারল্য সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নিতে হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।


মূল্যস্ফীতি ও জনগণের ভোগান্তি

উচ্চ ঋণের খরচ এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারকে বারবার জ্বালানির মূল্য বাড়াতে হয়, যা মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বাড়িয়ে তোলে। ২০২২–২৪ সালের মধ্যে সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, যার প্রভাব সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ে। এসময় সরকারের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় এবং ঋণের সুদ বাড়তে থাকায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা ছাড়া সরকারের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

দেশে যখন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে এবং ডলারের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। মূল্যস্ফীতি সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে এবং অর্থনৈতিক চাপে ফেলেছে।


পদ্মা সেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য এক বড় সাফল্য হলেও এর আর্থিক প্রভাব দেশের মুদ্রাবাজার এবং অর্থনীতিতে গভীর সংকট তৈরি করেছে। মুদ্রাবাজারে সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়, এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি—সবকিছুই পদ্মা সেতুর নিজস্ব অর্থায়নের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে সুদূরপ্রসারী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যা সাধারণ মানুষের আর্থিক চাপ কমাতে সহায়তা করবে।

ননিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে মুদ্রাবাজারে সংকট ও মূল্যস্ফীতি কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামাল

মন্তব্য করুন:






A Part of dearJulius.com Inc.
Made with in NYC by Julius Choudhury
নাম

অভিবাসন,2,অর্থ ও বাণিজ্য,40,আইন ও অপরাধ,56,আন্তর্জাতিক,66,আবহাওয়া,5,ইটালি,1,ইতালি,1,এভিয়েশন,1,কক্সবাজার,1,কলকাতা,1,কুড়িগ্রাম,1,কুমিল্লা,1,কুয়েত,1,কৃষি,1,ক্যালিফোর্নিয়া,1,খাগড়াছড়ি,1,খাদ্য,4,খেলা,7,গণমাধ্যম,13,গাজীপুর,378,গোপালগঞ্জ,1,জাতীয়,42,জাপান,1,জীবনধারা,7,ঢাকা,2,ঢাবি,1,দরকারি তথ্য,5,দিনাজপুর,1,নরসিংদী,2,নিউইয়র্ক,6,নিউজিল্যান্ড,1,পরিবহণ,1,পরিবেশ,3,পোশাক শিল্প,1,প্রযুক্তি,17,ফিনল্যান্ড,1,ফেনী,2,বাংলাদেশ,236,বিচিত্র,6,বিজ্ঞান,1,বিনোদন,3,বিশেষ প্রতিবেদন,13,ব্যাংকিং,1,ভারত,14,ভেনেজুয়েলা,2,ভ্রমণ,1,মতামত,1,মানিকগঞ্জ,1,মালয়েশিয়া,1,মিয়ানমার,1,যুক্তরাজ্য,2,যুক্তরাষ্ট্র,20,যোগযোগ,4,রাজনীতি,29,লক্ষ্মীপুর,1,লিবিয়া,1,শিক্ষা,14,শ্রীলঙ্কা,2,সংযুক্ত আরব আমিরাত,1,সারাদেশ,17,সিরাজগঞ্জ,1,সৌদি আরব,1,স্পেন,1,স্বাস্থ্য,21,
ltr
item
ডেইলি নিউজ | বিশ্বজুড়ে বাংলা সংবাদ, প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ: পদ্মা সেতু নির্মাণে নিজস্ব অর্থায়ন: মুদ্রাবাজারে সংকট ও মূল্যস্ফীতি কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামাল
পদ্মা সেতু নির্মাণে নিজস্ব অর্থায়ন: মুদ্রাবাজারে সংকট ও মূল্যস্ফীতি কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামাল
পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের ফলে মুদ্রাবাজারে সংকট এবং মূল্যস্ফীতি কীভাবে বাড়ল? জেনে নিন এই মেগা প্রকল্পের আড়ালে থাকা সর্বনাশী অর্থনৈতিক প্রভাবের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi6AyMiAHlmEvQ8STSzpumuA-FifXesGsWqQS8ijuhjg-Zt3Bk5YO3pABF1EyiczlQYRxc7x9hEIcB8ljCLaGzGfYY2RgVV-Msa8Zp2b-r5PnZMl-TEfFtYCCGw808NxJoROtOGmUB1m98XygKM_MotvapiZTV3_hALznu5NSH2Mt2-JC0Rlw_Ae9g-cuo/s16000/news.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEi6AyMiAHlmEvQ8STSzpumuA-FifXesGsWqQS8ijuhjg-Zt3Bk5YO3pABF1EyiczlQYRxc7x9hEIcB8ljCLaGzGfYY2RgVV-Msa8Zp2b-r5PnZMl-TEfFtYCCGw808NxJoROtOGmUB1m98XygKM_MotvapiZTV3_hALznu5NSH2Mt2-JC0Rlw_Ae9g-cuo/s72-c/news.jpg
ডেইলি নিউজ | বিশ্বজুড়ে বাংলা সংবাদ, প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ
https://bn.dailynewsview.com/2024/10/0124101915.html
https://bn.dailynewsview.com/
https://bn.dailynewsview.com/
https://bn.dailynewsview.com/2024/10/0124101915.html
true
8535116959523749911
UTF-8
সমস্ত পোস্ট লোড হয়েছে কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি সব দেখুন বিস্তারিত জবাব জবাব বাতিল ডিলিট লেখা: হোম পৃষ্ঠা পোস্ট সব দেখুন আপনার জন্য সুপারিশকৃত লেবেল আর্কাইভ খোঁজ সব পোস্ট আপনার অনুরোধের সাথে কোনো পোস্টের মিল পাওয়া যায়নি প্রচ্ছদে ফিরে যান Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec এইমাত্র 1 মিনিট আগে $$1$$ মিনিট আগে 1 ঘন্টা আগে $$1$$ hours ago গতকাল $$1$$ দিন আগে $$1$$ সপ্তাহ আগে 5 সপ্তাহেরও বেশি আগে অনুসারী অনুসরণ করুন THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content