![]() |
গাজীপুর মহানগর প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের মাঝেই রয়েছেন প্রতারক সাংবাদিকরা। |
বিশেষ প্রতিনিধি
তারা ছিলেন সংবাদ জগতের নীতির মুখপাত্র—কলমের সৈনিক। অথচ সেই পরিচয়ই ব্যবহার করলেন জনতার পকেট কেটে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে! গাজীপুরে ঘটেছে এমনই এক নজিরবিহীন প্রতারণার কাহিনি, যেখানে সাংবাদিকতার আড়ালে গড়ে তোলা হয় ভয়াবহ এক নিষিদ্ধ এমএলএম সাম্রাজ্য। তদন্তে উঠে এসেছে দুঃসাহসী প্রতারণার এমন কৌশল, যা হার মানাবে সিনেমার গল্পকেও।
গাজীপুরে সাংবাদিকতার পরিচয়কে ঢাল বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি অনলাইনভিত্তিক নিষিদ্ধ এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) ব্যবসা, যার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই দুর্ধর্ষ প্রতারণা চক্রের হোতারা কেউ সাধারণ মানুষ নন—তারা গাজীপুর মহানগর প্রেসক্লাবের শীর্ষ পর্যায়ের সাংবাদিক নেতা।
ঘটনাটি সামনে আসে বুধবার (১৬ জুলাই ২০২৫), যখন বিপুল সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী গাজীপুর মিডিয়া সেন্টারে এসে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের সর্বস্ব হারানোর অভিযোগ তুলে ধরেন। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, কীভাবে সাংবাদিকতার মর্যাদা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রভাবকে হাতিয়ার বানিয়ে এই দুর্বৃত্তরা জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, গাজীপুর মহানগর প্রেসক্লাবের সভাপতি আমজাদ খান, সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন, সহ-সভাপতি হাজি কামাল চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান জাহাঙ্গীর এবং সদস্য গোলাম রসুল দিনার—এই পাঁচজন মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে macvz.com ডোমেইনে “Mistral AI” এবং kiaix.com ডোমেইনে “KumoAI” নামের দুটি ওয়েব অ্যাপ চালু করেন।
সাংবাদিক পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে তারা প্রথমে সহকর্মী সাংবাদিকদের বিশাল মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন। বিনিয়োগের অল্পদিনের মধ্যে মোটা অংকের মুনাফা দেওয়া শুরু হলে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই পরিবারের সদস্য, পরিচিতজন এবং সাধারণ মানুষদেরও এই চক্রে যুক্ত করতে থাকেন। প্রতারণা চক্রটি ১৫% রেফারেল বোনাসের লোভ দেখিয়ে সারাদেশে শত শত নতুন বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করতে থাকে।
প্রতারণার অর্থ সংগ্রহে ব্যবহৃত হয় অসংখ্য ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক বিকাশ নম্বর এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি নগদ অর্থ নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চক্রটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দালাল নিয়োগ করে, যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে প্রলুব্ধ করে অবৈধভাবে বিনিয়োগ করানো হয়।
প্রতারকরা এ কাজে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য খোলাখুলি সভা-সেমিনার আয়োজন করেন। এর মধ্যে গত ১৯ জুন ২০২৫, গাজীপুরের দক্ষিণ ছায়াবিথীর কোর্টইয়ার্ড গার্ডেন ক্যাফেতে আয়োজিত একটি সেমিনারের চিত্র ইতোমধ্যেই এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে—যেখানে অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
তারা হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে এই প্রতারণামূলক ব্যবসার প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন। এমন এক পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে ১৪ জুলাই তারিখে তারেক রহমান জাহাঙ্গীর ঘোষণা দেন যে তাদের 'সিস্টেম হ্যাক' হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে গ্রুপে একের পর এক অভিযোগ পোস্ট করতে থাকেন, কিন্তু মালিকপক্ষ চুপচাপ থেকে যায়।
এরপর প্রতারকরা আবার কৌশল পরিবর্তন করে। ১৫ জুলাই তারিখে তারেক রহমান জাহাঙ্গীর নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বিনিয়োগকারীদের সেখানে যুক্ত করে “KumoAI” নামে নতুন একটি অ্যাপের প্রলোভন দেখিয়ে নতুন করে বিনিয়োগ আহ্বান করতে থাকেন। তারা আলাদাভাবে ভয়েস মেসেজ ও টেক্সট বার্তা দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
![]() |
ঢাকার অভিজাত লে মেরিডিয়ান হোটেলে সেমিনার করার জন্য বুকিং শেষে হোটেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারেক রহমান জাহাঙ্গীর ও এস এম ইকবাল হোসেনের ফটোশেসন। |
বিনিয়োগকারীদের উপর এর প্রভাব ছিল গুরুতর। অনেকে তাদের জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একজন বিনিয়োগকারী সাংবাদিক বলেন, "আমি তাদের প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে আমার সম্পূর্ণ অবসর তহবিল বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন আমার কাছে কিছুই নেই।" এই ধরনের ঘটনা শুধু আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং সাংবাদিকতা পেশার সুনামকেও ক্ষুণ্ন করে, গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করে।
এই ঘটনায় অভিযুক্তদের ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে প্রত্যেকে অন্যজনকে দোষারোপ করেন।
নিষিদ্ধ এমএলএম চক্রের অন্যতম হোতা আমজাদ খান, মামলা না করার শর্তে কয়েকজন বিনিয়োগকারী সাংবাদিককে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এই ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের সাথে আমজাদ খানের কথোপকথনের কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
গাজীপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি জুলীয়াস চৌধুরী বলেন, এই ভয়াবহ প্রতারণা কেলেঙ্কারি শুধুমাত্র একটি আর্থিক অপরাধ নয়, এটি সাংবাদিকতার পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহসী চেষ্টা। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং একইসঙ্গে দাবি করছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং তথ্য মন্ত্রণালয় যেন অবিলম্বে এই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেন। সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে গড়ে ওঠা এমন অপরাধ চক্র আমাদের সমাজ ও গণমাধ্যমের জন্য ভয়ানক হুমকি। আমরা চাই, দায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এই পেশার মর্যাদা নিয়ে এমন নির্মম প্রতারণার সাহস না পায়।
এই ঘটনায় অভিযুক্তদের ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে প্রত্যেকে অন্যজনকে দোষারোপ করেন।
নিষিদ্ধ এমএলএম চক্রের অন্যতম হোতা আমজাদ খান, মামলা না করার শর্তে কয়েকজন বিনিয়োগকারী সাংবাদিককে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এই ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের সাথে আমজাদ খানের কথোপকথনের কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
গাজীপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি জুলীয়াস চৌধুরী বলেন, এই ভয়াবহ প্রতারণা কেলেঙ্কারি শুধুমাত্র একটি আর্থিক অপরাধ নয়, এটি সাংবাদিকতার পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহসী চেষ্টা। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং একইসঙ্গে দাবি করছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং তথ্য মন্ত্রণালয় যেন অবিলম্বে এই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেন। সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে গড়ে ওঠা এমন অপরাধ চক্র আমাদের সমাজ ও গণমাধ্যমের জন্য ভয়ানক হুমকি। আমরা চাই, দায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এই পেশার মর্যাদা নিয়ে এমন নির্মম প্রতারণার সাহস না পায়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০১৩ সালের মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং অ্যাক্টিভিটিস (কন্ট্রোল) অ্যাক্ট অনুযায়ী, এমএলএম ব্যবসার জন্য লাইসেন্স প্রয়োজন, এবং পিরামিড স্কিম নিষিদ্ধ। এই অ্যাক্ট অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা বা জালিয়াতির জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া, প্রতারণার জন্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে।
ভিডিওতে দেখুন প্রতারক সাংবাদিকদের সেমিনার ...
মন্তব্য করুন: