জুলীয়াস চৌধুরী
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা যেন এক দুঃস্বপ্ন! নতুন উদ্যোক্তারা লাইসেন্স পেতে সংগ্রাম করছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ছেন, এবং বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। ১৯০টিরও বেশি নথি জোগাড় করার প্রয়োজন—এতটাই জটিল যে, চীন বা ইন্দোনেশিয়ায় যেখানে এ প্রক্রিয়া মাত্র কয়েকটি নথি দিয়ে সম্পন্ন হয়, বাংলাদেশে তা হয়ে উঠছে প্রায় অসাধ্য। এই অবস্থা শুধু দেশীয় উদ্যোক্তাদের নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলছে। তাহলে, কেন এই সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি?
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা কিংবা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় ২৩টি আলাদা আলাদা লাইসেন্স। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি লাইসেন্স প্রতিবছর বা ছয় মাস অন্তর অন্তর নবায়ন করতে হয়। এসব লাইসেন্স পেতে মোট ১৯০টি নথির প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ৩০টি নথি সাধারণত প্রতিবার দেওয়া হয় আর ১৬০টি নতুন করে জমা দিতে হয়। তুলনামূলকভাবে, চীন, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো দেশের ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও দ্রুততর। সেখানে পেপারওয়ার্কের ঝামেলা কম হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা শুরু করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা যেন এক দুঃস্বপ্ন! নতুন উদ্যোক্তারা লাইসেন্স পেতে সংগ্রাম করছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ছেন, এবং বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। ১৯০টিরও বেশি নথি জোগাড় করার প্রয়োজন—এতটাই জটিল যে, চীন বা ইন্দোনেশিয়ায় যেখানে এ প্রক্রিয়া মাত্র কয়েকটি নথি দিয়ে সম্পন্ন হয়, বাংলাদেশে তা হয়ে উঠছে প্রায় অসাধ্য। এই অবস্থা শুধু দেশীয় উদ্যোক্তাদের নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলছে। তাহলে, কেন এই সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি?
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা কিংবা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় ২৩টি আলাদা আলাদা লাইসেন্স। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি লাইসেন্স প্রতিবছর বা ছয় মাস অন্তর অন্তর নবায়ন করতে হয়। এসব লাইসেন্স পেতে মোট ১৯০টি নথির প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ৩০টি নথি সাধারণত প্রতিবার দেওয়া হয় আর ১৬০টি নতুন করে জমা দিতে হয়। তুলনামূলকভাবে, চীন, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো দেশের ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও দ্রুততর। সেখানে পেপারওয়ার্কের ঝামেলা কম হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা শুরু করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে বেশ কিছু সরকারি দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের নথি সংগ্রহ করতে হয়। এই নথিগুলো ব্যবসার ধরণ, আকার, এবং প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত নিচের দপ্তরগুলো থেকে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে হয়: ১. রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন সংক্রান্ত নথি
২. ট্যাক্স এবং ভ্যাট সংক্রান্ত নথি
৩. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত নথি
৪. বাণিজ্য লাইসেন্স
৫. পরিবেশগত অনুমোদন (যদি প্রযোজ্য হয়)
৬. মজুরি বোর্ড ও শ্রম আইন (যদি কর্মচারী থাকে)
৭. বৈদেশিক বিনিয়োগ সংক্রান্ত (যদি প্রযোজ্য হয়)
৮. আয়তন অনুযায়ী অনুমোদন (ক্ষুদ্র/মাঝারি/বড়)
এছাড়া বিশেষ কোনো ব্যবসার জন্য অতিরিক্ত অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রয়োজন হতে পারে, যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসার জন্য ড্রাগ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন, অথবা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) থেকে লাইসেন্স। |
লাইসেন্সের বোঝা ও দুর্নীতি
ব্যবসায়িক লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ১৯০টি নথি সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা শুধু নথিপত্রের ঝামেলাতেই আটকে পড়ছেন না, বরং ঘুষের মতো সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে প্রতিটি লাইসেন্স নবায়ন বা নথি জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি যেন একটি অঘোষিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। পেপারওয়ার্ক বা আইনি বাধার চেয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতি।উদাহরণ হিসেবে এক মার্কিন কোম্পানি
একটি মার্কিন ভিত্তিক ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) কোম্পানির বিনিয়োগের উদাহরণটি এক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি ও বড় বিনিয়োগ করার পরেও, শুধুমাত্র লাইসেন্স পেতে বিলম্ব হওয়ার কারণে তারা এখনো বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে পারেনি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, আমলাতন্ত্রের কারণেই ৯৯ শতাংশ বিলম্ব ঘটেছে। বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি পেতে এবং গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগে দীর্ঘ সময় লেগেছে।এই মার্কিন কোম্পানির অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন বাংলাদেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকেই লাইসেন্স জটিলতার কারণে পরিকল্পনা বাতিল করছেন, যেমনটি করেছিলেন ভিয়েতনামের একজন চামড়া প্রস্তুতকারক শিল্পের উদ্যোক্তা, যিনি লাইসেন্স গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাতিল করেন।
দেশের ভিতরেও একই সমস্যা
যদিও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়ছেন, দেশীয় ব্যবসায়ীরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। লাইসেন্স পেতে দীর্ঘ সময় এবং খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শেষমেশ ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশ লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এলএফএমইএ) মতে, অনেক লাইসেন্সই অপ্রয়োজনীয় এবং সেগুলো বাদ দেওয়া উচিত।অন্যান্য দেশে পেপারওয়ার্ক সহজ
চামড়াখাতের ব্যবসায়ীরা চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, চীনে একটি ব্যবসা শুরু করতে ১৭টি নথির প্রয়োজন হয়, ভিয়েতনামে ২১টি এবং কম্বোডিয়ায় মাত্র ২৩টি। বাংলাদেশে যেখানে ২৩টি আলাদা আলাদা লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়, ভিয়েতনামে একই ধরনের ব্যবসার জন্য লাগে মাত্র পাঁচটি সনদ।প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা
বাংলাদেশের মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, দেশের ব্যবসার খরচ কমাতে এবং 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' সূচকে উন্নতি করতে হলে লাইসেন্সের সংখ্যা কমানো অত্যন্ত জরুরি। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের পরে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুবিধা হারাবে, তাই এখনই ব্যবসার খরচ কমানো জরুরি।এছাড়া, বাংলাদেশ নিটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, তৈরি পোশাক খাতেও ২২টি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। এসব লাইসেন্স পেতে ঘুষ ছাড়াও নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, যা সময় ও খরচ বৃদ্ধি করে।
সরকারী পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি
অন্যদিকে, কাস্টমস বন্ড, রপ্তানি ও আইটি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আনার কাজ চলছে। তবে কাস্টমসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, শুধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের দিক থেকেই সমস্যা নয়, ব্যবসায়ীদের দিক থেকেও সমস্যা আছে।বিডার ওয়ান-স্টপ সার্ভিস: ব্যর্থতার প্রমাণ
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২০১৯ সালে একটি ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করে, যা সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে ব্যবসায়িক সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও এটি তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। বিভিন্ন সংস্থার অক্ষমতা এবং সহযোগিতার অভাব এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা এবং পরিচালনা করার জটিলতা ব্যবসায়ীদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইসেন্স পেতে যে বিশাল পরিমাণ নথি জোগাড় করতে হয়, তা যেমন সময়ক্ষেপণ করছে, তেমনি দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তুলছে। এই সমস্যা শুধুমাত্র দেশীয় ব্যবসায়ীদের নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও নিরুৎসাহিত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করা হলেও, বাস্তবিক পরিবর্তন দেখতে আরও সময় লাগবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, ব্যবসার খরচ কমানো এবং সহজে ব্যবসা করার পথ সুগম করতে হবে। এজন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা এবং লাইসেন্স প্রক্রিয়া সরলীকরণ অত্যন্ত জরুরি।
মন্তব্য করুন: