পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরণ উপায় শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। ছবি: বিআরএফ |
গাজীপুরের একসময়কার সবুজ বনানী ও জলাশয় কোথায় হারিয়ে গেল? ধীরে ধীরে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলার পরিবেশ, বেড়ে চলেছে দখল, দূষণ আর নির্বিচারে গাছ কর্তন। ২৩ বছরের মধ্যে ঘটেছে ভয়াবহ পরিবর্তন, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজীপুর, বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা, যেখানে গত ২৩ বছরে জলাশয় এবং বনভূমি ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। ২০০০ সালের তুলনায় বনভূমি ও জলাশয়ের পরিমাণ কমে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ, যা এক সময় ছিল গাজীপুরের পরিবেশের সুরক্ষা বেষ্টনী। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো অপ্রতিরোধ্য নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
এই বিষয়টি নিয়ে আজ মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর ২০২৪) গাজীপুর পিটিআই অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত আলোচনা করেন। ‘পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তাঁর উপস্থাপিত জরিপে দেখানো হয়েছে, ২০০০ সালের পর থেকে এই অঞ্চলের বনভূমি এবং জলাশয়ের ব্যাপক পতন হয়েছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনের কারণ
এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে ২০২৩ সালে, যাতে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। জরিপে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গাজীপুরে বনভূমির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ থেকে কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, জলাশয় কমেছে ১১ হাজার ৪৬২ হেক্টর থেকে ৫ হাজার ৫৬৮ হেক্টরে।এই ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, যা এলাকাটির সবুজায়নকে তছনছ করে দিয়েছে। গাজীপুরে তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, চিলাইসহ নদীগুলোতে অব্যাহতভাবে শিল্পবর্জ্য ও অন্যান্য দূষণ বেড়েছে। এ কারণে এলাকার জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশগত এই পতনের প্রভাব শুধু পরিবেশের উপরই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
জনসংখ্যা ও বসতি বৃদ্ধি
গাজীপুরের জনসংখ্যা ২০১১ সালে যেখানে সাড়ে ৩০ লাখ ছিল, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখে। এই বিশাল জনসংখ্যার চাপ পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮ হাজার ১২৬ জন মানুষ বসবাস করছে, যা দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে বন ও জলাভূমি ভরাট করে নতুন আবাসিক এলাকা তৈরি করা হচ্ছে, এবং পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংস হচ্ছে।বনভূমি এবং জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে গাজীপুরে মোট জলাশয় ছিল ১১ হাজার ৪৬২ হেক্টর, যা কমে বর্তমানে ৫ হাজার ৫৬৮ হেক্টরে নেমে এসেছে। আবার, বনভূমি ২৩ বছর আগে ছিল ৩৯ হাজার ৯৪৩ হেক্টর, যা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬ হাজার ১৭৪ হেক্টরে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, গাজীপুরের মতো একটি জেলায় মোট আয়তনের কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত।অপরদিকে, গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানব বসতি ও শিল্পকারখানা দ্রুত বেড়ে চলেছে। ২০০০ সালে যেখানে মানব বসতি ছিল ৮৫ হাজার ৫৭৩ হেক্টর, ২০২৩ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ১৭৯ হেক্টরে। এই অব্যাহত বসতি বিস্তারের কারণে বনভূমি এবং উন্মুক্ত জায়গা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে। গবেষণা অনুযায়ী, খোলা জায়গার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩১৬ হেক্টরে, যেখানে ২০০০ সালে ছিল ৫ হাজার ৪৩৬ হেক্টর।
আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের মতামত
অনুষ্ঠানে বেলার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, "পরিবেশগত বিপর্যয়ের এই চিত্র দেখে আমরা হতাশ হতে পারি না। এটি আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। নগরায়ণ ও উন্নয়ন আমরা চাই, তবে সেই উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।" তাসলিমা আরও বলেন, "দখল এবং দূষণ রোধ করতে আমাদের সক্রিয় হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।"বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, "আমাদের প্রতিদিন বনভূমি দখলের অভিযোগ পাচ্ছি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি, তবে এটি সমাধানের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা।"
গাজীপুরের পরিবেশগত বিপর্যয় আজ কেবল স্থানীয় কোনো সমস্যা নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক পরিবেশের উপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। বনভূমি এবং জলাশয়ের হারানো সম্পদ আমাদের ভবিষ্যতকে বিপন্ন করছে। গাজীপুরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের পরিবেশের এমন পতন শুধু শিল্পায়ন বা নগরায়ণের ফল নয়, এটি সঠিক পরিকল্পনার অভাব, অপ্রতুল পরিবেশ সুরক্ষা নীতির ব্যর্থতারও প্রতিফলন।
এ অবস্থায় পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। পরিবেশের সুরক্ষা শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই সম্ভব হবে না, এর জন্য দরকার কড়া আইন বাস্তবায়ন এবং পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ। গাজীপুরের পরিবেশ পুনরুদ্ধার করতে হলে বনভূমি এবং জলাশয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, এবং দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ সংস্থা, এবং জনগণের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় তৈরি করাই হবে উত্তরণের একমাত্র পথ।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন, বাপার গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক হাসান খান, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, গাজীপুর বিএম কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির, গাজীপুর নদী পরিব্রাজক দলের সাধারণ সম্পাদক এম. আসাদুজ্জামান সাদ, আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান আকাশ প্রমুখ।
মন্তব্য করুন: