রিজার্ভ থেকে ডলার না নিয়েই দেড় বিলিয়ন ঋণ কীভাবে শোধ করল বাংলাদেশ?

জুলীয়াস চৌধুরী

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনা হলো রিজার্ভ থেকে ডলার না নিয়ে বিশাল ঋণ শোধের ক্ষমতা অর্জন। যেখানে আগে ডলার সংকট নিয়ে দেশবাসী ও অর্থনীতিবিদদের মনে ছিল ব্যাপক উদ্বেগ, সেখানে এখন ডলারের প্রাচুর্যতা এবং আন্তব্যাংক লেনদেনের সুবিধা নিয়ে দেশের ঋণ পরিশোধের কৌশল দেখিয়ে দিল অর্থনৈতিক উন্নতির নতুন দিগন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে এবং দেশ কীভাবে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করছে, তা জানতে চাইলে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নীতিমালার কারণে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতি এবং অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণে আসায়, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাতের ডলারের সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে দেশকে ভয়াবহ ডলার সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। ফলে, গত দুই মাসে রিজার্ভ থেকে কোনও ডলার না নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক ১.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বিষয়টি নিয়ে বলেন, "প্রথমে আমাদের ব্যাংকগুলোতে ডলারের বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে এখন ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ বেড়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে প্রয়োজনীয় ডলার নিয়ে আমরা ঋণ পরিশোধ করতে পেরেছি, রিজার্ভ থেকে কোনও ডলার নিতে হয়নি।"

ড. মনসুরের মতে, দেশের ব্যাংকগুলোতে প্রাপ্ত ডলারগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সফলভাবে বিদ্যুৎ, সার, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ঋণ শোধ করতে পেরেছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকে প্রচুর রেমিট্যান্স জমা হওয়ায় তারা সোনালী ব্যাংককে ডলার সরবরাহ করেছে, যাতে সোনালী ব্যাংক প্রয়োজনীয় দেনা শোধ করতে পারে। এতে দেশের রিজার্ভে কোনও প্রভাব পড়েনি এবং বকেয়া ঋণের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে।

গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে ডলারের সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। আদানি, শেভরন, কাফকো এবং অন্যান্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার বকেয়া জমা হয়েছিল। এই বকেয়া দুই মাসের মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এখনও ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বকেয়া রয়েছে, যা অচিরেই পরিশোধের লক্ষ্যে রয়েছে।

গভর্নর আরও জানান, ডলারের মজুদ কম থাকলেও, টাকার লেনদেন এবং মজুদের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ফলে দেশের মুদ্রানীতি এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।


ডলারের প্রতি আগ্রহের হ্রাস

দেশের বাজারে ডলারের চেয়ে টাকার প্রতি মানুষের আগ্রহ এখন বেশি। কারণ ডলারের তুলনায় টাকাতে বিনিয়োগ করলে সুদের হার বেশি পাওয়া যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও কমতে শুরু করেছে, এবং আমদানির ক্ষেত্রে তেল, গ্যাস এবং সারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সংকট কিছুটা হলেও কাটতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে দেশ বাকি ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। এই সময়কালের মধ্যে সমস্ত দেনা পরিশোধের পর দেশ আরও ইতিবাচক অর্থনৈতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন গভর্নর। বিশেষ করে অর্থপাচার এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরও সুসংহত হয়েছে।


জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের প্রভাব

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত প্রায় সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে তেল, গ্যাস এবং কয়লা প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই খাতগুলোতে প্রতিবছর প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, যার ফলে দেশের ডলারের চাহিদা বাড়ে। ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির পেছনে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সময়মতো এই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।

যার ফলে, বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান যেমন আদানি, শেভরন, কাফকোর কাছে বিশাল বকেয়া জমা হয়েছিল। তবে, ২০২৪ সালে এসে আন্তব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে এই ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ডলারের প্রাচুর্যের কারণে রিজার্ভ থেকে কোনও ডলার নেওয়া হয়নি, যা দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে।


ফরেক্স রিজার্ভ বৃদ্ধির ধারা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন যে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে মূলত ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য গৃহীত কার্যকর নীতিমালা কাজ করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার নেট রিজার্ভ ছিল ১৯.৮২ বিলিয়ন ডলার, এবং মোট রিজার্ভ ছিল ২৪.৯৭ বিলিয়ন ডলার।

গভর্নর আরও বলেন, দেশের ঋণ পরিশোধের পর বাজারে তারল্য বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতি আরও বাড়বে। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে আরও ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহের জন্য। এই ঋণ দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।


অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বর্তমানে দেশের উপর ১০৩ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণের চাপ রয়েছে। তবে, ড. মনসুরের মতে, এই চাপ সামলাতে ধৈর্য্য ধরে চলতে হবে এবং অন্তত এক বছর সময় দিতে হবে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর সফল বাস্তবায়ন হলে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবিষ্যতে আরও বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে করে দেশের সার্বিক বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। এছাড়া, দেশের ব্যবসায়ী মহলের আস্থা পুনরুদ্ধার হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ স্থিতিশীল হবে।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক ঋণ পরিশোধ এবং ডলার সংকট মোকাবিলার কৌশল একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আন্তব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টি প্রমাণ করেছে যে, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করলে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যদিও সামনে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার যেভাবে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে, তাতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আরও সুদূরপ্রসারী।

মন্তব্য করুন:






A Part of dearJulius.com Inc.
Made with in NYC by Julius Choudhury
নাম

অভিবাসন,2,অর্থ ও বাণিজ্য,40,আইন ও অপরাধ,56,আন্তর্জাতিক,66,আবহাওয়া,5,ইটালি,1,ইতালি,1,এভিয়েশন,1,কক্সবাজার,1,কলকাতা,1,কুড়িগ্রাম,1,কুমিল্লা,1,কুয়েত,1,কৃষি,1,ক্যালিফোর্নিয়া,1,খাগড়াছড়ি,1,খাদ্য,4,খেলা,7,গণমাধ্যম,13,গাজীপুর,378,গোপালগঞ্জ,1,জাতীয়,42,জাপান,1,জীবনধারা,7,ঢাকা,2,ঢাবি,1,দরকারি তথ্য,5,দিনাজপুর,1,নরসিংদী,2,নিউইয়র্ক,6,নিউজিল্যান্ড,1,পরিবহণ,1,পরিবেশ,3,পোশাক শিল্প,1,প্রযুক্তি,17,ফিনল্যান্ড,1,ফেনী,2,বাংলাদেশ,236,বিচিত্র,6,বিজ্ঞান,1,বিনোদন,3,বিশেষ প্রতিবেদন,13,ব্যাংকিং,1,ভারত,14,ভেনেজুয়েলা,2,ভ্রমণ,1,মতামত,1,মানিকগঞ্জ,1,মালয়েশিয়া,1,মিয়ানমার,1,যুক্তরাজ্য,2,যুক্তরাষ্ট্র,20,যোগযোগ,4,রাজনীতি,29,লক্ষ্মীপুর,1,লিবিয়া,1,শিক্ষা,14,শ্রীলঙ্কা,2,সংযুক্ত আরব আমিরাত,1,সারাদেশ,17,সিরাজগঞ্জ,1,সৌদি আরব,1,স্পেন,1,স্বাস্থ্য,21,
ltr
item
ডেইলি নিউজ | বিশ্বজুড়ে বাংলা সংবাদ, প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ: রিজার্ভ থেকে ডলার না নিয়েই দেড় বিলিয়ন ঋণ কীভাবে শোধ করল বাংলাদেশ?
রিজার্ভ থেকে ডলার না নিয়েই দেড় বিলিয়ন ঋণ কীভাবে শোধ করল বাংলাদেশ?
রিজার্ভ থেকে ডলার না নিয়েই দেড় বিলিয়ন ঋণ কীভাবে শোধ করল বাংলাদেশ? জানুন এই চমকপ্রদ অর্থনৈতিক কৌশল ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiCOIE-bfydBdy28JVn3OvI2XONq-ag42iLrMLAlkQPPypfeJtyUmaGRqS3VrbY0snw2ZBZuI7Zb_YSVR209sLPb1T1CK8Hu0pprWixpqemlenS6lK3Qt5XMZj7buX5zRkl364zxBc57Eaor3VV9zxXgoQ3rTMndAJ6EZPiwre-LKf-QkC-NDupexLN5eU/s16000/news.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiCOIE-bfydBdy28JVn3OvI2XONq-ag42iLrMLAlkQPPypfeJtyUmaGRqS3VrbY0snw2ZBZuI7Zb_YSVR209sLPb1T1CK8Hu0pprWixpqemlenS6lK3Qt5XMZj7buX5zRkl364zxBc57Eaor3VV9zxXgoQ3rTMndAJ6EZPiwre-LKf-QkC-NDupexLN5eU/s72-c/news.jpg
ডেইলি নিউজ | বিশ্বজুড়ে বাংলা সংবাদ, প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ
https://bn.dailynewsview.com/2024/10/0124102010.html
https://bn.dailynewsview.com/
https://bn.dailynewsview.com/
https://bn.dailynewsview.com/2024/10/0124102010.html
true
8535116959523749911
UTF-8
সমস্ত পোস্ট লোড হয়েছে কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি সব দেখুন বিস্তারিত জবাব জবাব বাতিল ডিলিট লেখা: হোম পৃষ্ঠা পোস্ট সব দেখুন আপনার জন্য সুপারিশকৃত লেবেল আর্কাইভ খোঁজ সব পোস্ট আপনার অনুরোধের সাথে কোনো পোস্টের মিল পাওয়া যায়নি প্রচ্ছদে ফিরে যান Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec এইমাত্র 1 মিনিট আগে $$1$$ মিনিট আগে 1 ঘন্টা আগে $$1$$ hours ago গতকাল $$1$$ দিন আগে $$1$$ সপ্তাহ আগে 5 সপ্তাহেরও বেশি আগে অনুসারী অনুসরণ করুন THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content