জুলীয়াস চৌধুরী
বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সংকট, ডলার সঙ্কট, এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবে গত কয়েক মাসে দেশের শত শত প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে লক্ষাধিক মানুষ চাকরির অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের ব্যবসা খাতের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।
গত দুই মাসে (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর, ২০২৪) বাংলাদেশে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সিটি গ্রুপ, বিএসআরএম, ইউএস-বাংলাসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলো তাদের বেশকিছু কোম্পানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্ধ হতে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছোট থেকে বড় সব ধরনের ব্যবসা রয়েছে, যার ফলে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সংকট, ডলার সঙ্কট, এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবে গত কয়েক মাসে দেশের শত শত প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে লক্ষাধিক মানুষ চাকরির অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের ব্যবসা খাতের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।
গত দুই মাসে (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর, ২০২৪) বাংলাদেশে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সিটি গ্রুপ, বিএসআরএম, ইউএস-বাংলাসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলো তাদের বেশকিছু কোম্পানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্ধ হতে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছোট থেকে বড় সব ধরনের ব্যবসা রয়েছে, যার ফলে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে।
সংকটের কারণ
বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বিক্রি কমে যাওয়া, সুদের উচ্চ হার এবং শ্রম অসন্তোষের কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা ব্যাপক সমস্যায় পড়েছেন। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির সমস্যা, পরিবহন এবং কারিগরি অসুবিধাও এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। একই সাথে, বৈশ্বিক যুদ্ধ এবং আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগও অনেক কোম্পানির টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে।আরজেএসসির তথ্য
সরকারি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে ১২৮টি কোম্পানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ৪৬টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, আর সেপ্টেম্বরে আরও ২৬টি প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে গেছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানি বন্ধের হার দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।বন্ধ হচ্ছে যেসব কোম্পানি
দেশের শীর্ষ স্থানীয় করপোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ তাদের ৩০টি কোম্পানি বন্ধ করে দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সিটি হেয়ার অয়েল, দি এশিয়া প্যাসিফিক রিফাইনার্স, সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ (ইউনিট-২), হাসান ডাল মিলস, সিটি ফাইবার্স, হাসান পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, হামিদা প্লাস্টিক কনটেইনার্স, হাসান প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটি বিস্কুট, সিটি কনডেন্সড মিল্ক, হামিদা অ্যাগ্রো ফুড, শম্পা পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি, রূপসী সুগার মিলস, শম্পা সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটি পোলট্রি ও ফিশ ফিড, সিটি ভেজিটেবল অয়েল মিল, কোনাপাড়া অয়েল মিলস, হাসান ভেজিটেবল অয়েল মিলস, এফ রহমান অয়েল মিলস, আজগর অয়েল মিলস, ফারজানা অয়েল রিফাইনারিজ, সিটি ব্র্যান অয়েল, সিটি কোকোনাট অয়েল মিল, রহমান কোকোনাট অয়েল মিলস, সাগুরনাল হ্যাচারি অ্যান্ড ফিশারিজ, এফ রহমান শিপিং লাইনস, সিটি প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল, হোসেন্দি পেপার মিলস, সিটি টেস্টি বাইট ও দ্বীপা ফুড প্রডাক্টস। এসব কোম্পানি বন্ধে অবসায়ক (অবসানের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত বা ব্যক্তি সংস্থা) নিয়োগ দিয়েছে গ্রুপটি। অবসায়ক আইনজীবী জি কে রাজবংশী কোম্পানি বন্ধের জন্য সেপ্টেম্বরে ইজিএম আহ্বান করেন।
ইউএস-বাংলা গ্রুপ তাদের পাঁচটি কোম্পানি বন্ধ করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে গত সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানির ইজিএম হয়েছে। ওই সভায় ইউএস-বিডি সিকিউরিটি সার্ভিস, ইউএস-বাংলা গ্রুপ, ইউএস-বাংলা ফার্নিচার, ইউএস-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইউএস-বাংলা অ্যাগ্রোর জন্য অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পিতার নামে মাদারীপুরে গড়া প্রতিষ্ঠান আসমত আলী খান সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেড বন্ধ হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি কোম্পানি ল্যাব কোয়েস্টও বন্ধ হচ্ছে। ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএম গ্রুপের বিএসআরএম রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধের জন্য সিফিক বসাক অ্যান্ড কোংকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ডায়মন্ড গোল্ড ওয়ার্ল্ড ও ডায়মন্ড গোল্ড ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ হচ্ছে । বন্ধ হচ্ছে পেপার কাপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনটেক গ্রিনপ্যাকও।বন্ধ হচ্ছে বিদেশি যেসব কোম্পানি কোম্পানি
গত আগস্টে জিনপেং ট্রেডিং কোম্পানি বন্ধের জন্য অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেন সুহুই। বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে তাইওয়ানভিত্তিক মেরিল্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিও। সিঙ্গাপুরভিত্তিক হুইডিং প্রাইভেট কোম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানি ব্রাইড মেডিক্যাল অ্যান্ড এডুকেশন সার্ভিস লিমিটেড গত ১১ আগস্ট ইজিএমে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা স্বেচ্ছায় এটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতভিত্তিক আন্তর্জাতিক কোম্পানি শিপকার্ড মেরিন বাংলাদেশ লিমিটেড স্বেচ্ছায় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাইট টেক ইন্টারন্যাশনাল (এসএ) লিমিটেড তাদের দ্বিতীয় ইজিএমে বন্ধের অনুমোদন করা হয়েছে।
নতুন কোম্পানির নিবন্ধন
তবে সবকিছু সত্ত্বেও নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের হারও বাড়ছে। গত পাঁচ মাসে (মে-সেপ্টেম্বর) ৩,৮০৫টি নতুন কোম্পানি নিবন্ধন পেয়েছে, যা ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তবে বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি উদ্যোগ ও নীতি সহায়তা ছাড়া এই নতুন ব্যবসাগুলোর টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।দেশে (সেপ্টেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত) আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২,৯৫,৪৭১টি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, "বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার খরচ ক্রমশ বাড়ছে, যার পেছনে বন্দর শুল্কায়ন জটিলতা এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার প্রধান ভূমিকা রাখছে।" তিনি আরও জানান, এ ধরনের সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে দেশের বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ আসা কঠিন হয়ে পড়বে।বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চাকরির সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ৮৪.৯ শতাংশ কর্মসংস্থান এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিক্রিয়া
কিছু কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে, আবার কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন— স্কয়ার, যমুনা গ্রুপ, বেক্সিমকো, নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা করছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আবার বাড়বে।বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের জন্য সংকট সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে নতুন কোম্পানি গঠনের হার কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে সংকট উত্তরণে সরকারের সক্রিয় সহায়তা, সুদ ও শুল্ক নীতি সংস্কার এবং ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা জরুরি। দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধের হার যদি এভাবে অব্যাহত থাকে, তবে দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মন্তব্য করুন: