
করেসপন্ডেন্ট, গাজীপুর
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) লিফট, ও এসি সরবরাহ ও স্থাপন না করে কোটি কোটি টাকা বিল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
নগর ভবনের ওই কাজের নথিপত্র ঘেটে জানা যায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় অর্থাৎ নগর ভবনের চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, মালামাল সরবরাহ এবং নগর ভবনের একটি লিফট স্থাপনের জন্য গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে অঞ্চল-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী একটি দরপত্র আহবান করেন। যার স্মারক নাম্বার জিসিসি জেড.ফোর.এনবি২০১৯ ওবি। এই দরপত্রে সিটি কর্পোরেশনে নগর ভবনের চতুর্থ তলার নির্মাণ করন শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয় ৪ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। পরে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ৬ মাসের মধ্যে এই কাজ বাস্তবায়নের জন্য জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। কাজের মধ্যে নগর ভবনের ৪র্থ তলা নির্মাণ, বিভিন্ন কক্ষে ১৯টি এসি, একটি লিফট স্থাপন, নতুন নবনির্মিত অংশ সজ্জিত করন, ডিজিটাল পিএবিএক্স সিস্টেম স্থাপনসহ বিভিন্ন কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ লক্ষ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিওটেককে ২০২০ সালের ২২ মার্চ নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে জিসিসি। চুক্তি অনুযায়ী কার্যাদেশ প্রদানের তারিখ থেকে এই কাজের মেয়াদ ধরা ছিল ৬ মাস।
নগর ভবনের সংশ্লিষ্টরা জানায়, জিসিসির প্রধান কার্যালয় অর্থাৎ নগর ভবন ছিল তিন তলা বিশিষ্ট। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এডভোকেট মোঃ জাহাঙ্গীর আলম নগর ভবন উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ছিল নগর ভবনকে উর্ধ্বমুখী চতুর্থ তলা সম্প্রসারণ কার্যক্রম। এর অংশ হিসেবে উল্লেখিত দরপত্র আহবান করা হয় এবং জাহাঙ্গীর আলমের পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। কাজ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নগর ভবনের চতুর্থ তলার অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ তলার বেশিরভাগ অংশে প্লাস্টার, টাইলস, ইলেকট্রিক ওয়ারিং, বিভিন্ন কক্ষে এসি সরবরাহ এবং চতুর্থ তলায় ওঠার জন্য লিফট স্থাপন কাজ সম্পাদন করা হয়নি। তবে ৪ তলার কিছু অংশে ফ্লোর টাইলস করা হলেও সেগুলোর ফিনিশিং এবং বৈদ্যুতিক ওয়ারিং লাইট, ফ্যান, জানালার গ্লাসের কাজ শেষ করা হয়নি। সবচেয়ে বড় অনিয়ম হলো চতুর্থ তলায় উঠা-নামার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম লিফট স্থাপন কাজ এবং সংশ্লিষ্ট কোন মালামাল সরবরাহ বা স্থাপন না করা।
তবে কার্যাদেশ পাওয়ার পর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চার দফায় ৩ কোটি, ৮৯ লক্ষ ২৯ হাজার, ৭৪৫ টাকা বিল উত্তোলন করে নিয়েছেন। লিফট স্থাপনের নির্ধারিত স্থানে লিফট কোরের কাজও সম্পন্ন করা হয়নি।
এ বিষয়ে জিসিসির ইলেকট্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ইব্রাহিম খলিল জানান, এ কাজ বাস্তবায়নের সময় তাকে টঙ্গী জোনাল অফিসে বদলী করা হয়েছিল। কয়েক দিন আগে তাকে নগর ভবনের প্রধান কার্যালয়ে ফের বদলী করে আনা হয়েছে। নথি দেখে এ কাজের সর্বশেষ অবস্থা জানানোর অনুরোধ করলে তিনি জানান, লিফট স্থাপনের জন্য ৭২ লক্ষ্য ৬১ হাজার ৯১ টাকা ধরা ছিল। উক্ত টাকা অগ্রীম বাবদ দ্বিতীয় কিস্তিতে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছেন। এছাড়াও নবনির্মিত চতুর্থ তলায় বিভিন্ন কক্ষে সরবরাহ বাবদ ৮ লক্ষ ১৬ হাজার ৩শত ৩৬ টাকা, ডিজিটাল পিএবিএক্স স্থাপন বাবদ ২ লক্ষ ৭৯৬৮ টাকা, আন্ডার গ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের জন্য ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৭শত ৬৭ টাকাসহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন ৪ দফায় মোট ৩ কোটি, ৮৯ লক্ষ, ২৯ হাজার, ৭ শত ৪৫ টাকা বিল তুলে নিয়েছেন।
জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিং এর এই কাজের তদারককারী আমিনুল ইসলাম ঘটনাটি স্বীকার করে বলেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব কাজই তদারকি করেন। নগর ভবনের ৪র্থ তলা বর্ধিত করনের এই কাজটি এখনো চলমান রয়েছে, সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সময় কার্যাদেশ পেয়ে ভবনের কাজটি শুরু করে ছিলাম। এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই কাজের অংশ হিসেবে লিফট এবং এসি বাবদ প্রায় এক কোটি টাকা অগ্রীম বিল তুলে নিই। লিফটের এলসি করা হয়েছে, মালামাল আসতে সময় লাগছে, এই ভবনে লিফট লাগতে আরো তিন-চার মাস সময় লাগতে পারে। এসি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু এসি লাগানো হয়েছে বাদবাকি এসিগুলো শীঘ্রই লাগানো হবে। তাছাড়া কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে **** ১০টি এসি লাগানো হয়েছে, প্রয়োজনে ওই এসির বিলের সাথে নগর ভবনের এসির বিলের সাথে বিল সমন্বয় করা হবে।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক নুর উদ্দিন মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কাজটি মুলত তার ফার্মের নামে (জিওটেক ইঞ্জনিয়ারিং কর্পোরেশন) দেওয়া হলেও আমনিুল নামে পরিচিত এক বড় ভাই কাজটি করছেন। সিটি কর্পোরেশনে তার অনেকগুলো কাজ চলমান এবং বিল আটকা আছে, তবে এ কাজটি দ্রুত গতিতে চলমান আছে। অগ্রীম বিল নিয়েও কাজ করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সব বিষয়গুলো জানি না, বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে পরে জানাব।
২০২১ সালে দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) শামসুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কার্যাদেশ দেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ঠিকাদার কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি করায় কাজটি এখনো চলমান আছে। এর মধ্যে কয়েক দফায় ঠিকাদারকে অগ্রীম বিল প্রদান করা হয়েছে। সে সময় একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে এরকম আরো অনেক কাজের অগ্রীম বিল দিতে হয়েছে। পরে ঠিকাদারের সাথে লেগে থেকে কাজ আদায় করতে হয়েছে, এ কাজটি আমারা আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) আসাদুর রহমান কিরনের নিকট নগর ভবনে কোন লিফট আছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, নগর ভবনে এ পর্যন্ত তিনি কোন লিফট দেখতে পান নাই, ভবনের ৪ তলা সম্প্রসারনের কাজ চলমান রয়েছে, এই কাজ বা বিলে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তিনি তা নির্বাহী প্রকৌশলীদের খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ঠিকাদার বা অন্য কারো গাফিলতি অথবা অনিয়ম হয়ে থাকলে বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।
মন্তব্য করুন: