
করেসপন্ডেন্ট, গাজীপুর
ভুয়া দরপত্র, দরপত্রে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎসহ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এসব টাকা লুটপাটের অভিযোগের গোয়েন্দা অনুসন্ধান শেষে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। দীর্ঘ গোয়েন্দা অনুসন্ধান শেষে এবার প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করার জন্য দুদক কমিশনের কাছে সুপারিশ করেছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। জাহাঙ্গির আলমের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে উঠা অভিযোগটির গোয়েন্দা অনুসন্ধান শেষ করেছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার দেওয়া প্রতিবেদনটি এখন গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালকের কাছে জমা দেয়ার অপেক্ষায় আছে।
এদিকে গাজীপুরের এক মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম ও তার ঘনিষ্ট সহচরদের দুর্নীতি-অনিয়মের অনুসন্ধানসহ সম্পদের হিসাব চেয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে আইনগত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত ৬ জুলাই প্রধান কার্যালয়ে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
নির্ভরযোগ্য ও প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায়, বিগত কয়েক বছরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ টেন্ডারেই ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ঠিকাদারকে সুবিধা দিয়ে মেয়র জাহাঙ্গির আলমসহ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাভবান হয়ে সরকারের ক্ষতি করেছেন। তারা ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি ও বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। মাস্টার রোলে লোক নিয়োগের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিশ্ব এজতেমার নাম করে পাটের চট, চাটাই, ব্লিচিং পাউডার, মশার ওষুধ, আপ্যায়ন, বালি ভরাট, রাস্তা সংস্কার, লাইট ও পানি ইত্যাদি খাতে বিপুল অর্থ অপচয়সহ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব লুটপাটে বাধা দেয়ায় এবং কাজ না করে বিল ভাওচারে স্বাক্ষর না করায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে খুন করা হয়। তিনি কোনাবাড়ী জোনের প্রকৌশলী ছিলেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, খুনের বিষয়টি তাদের তফসিলভুক্ত নয়। তারা শুধু দুর্নীতির বিষয়টির অনুসন্ধান করছে। মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের দুটির প্রকাশ্য অনুসন্ধান আগেই শুরু করা হয়েছিল।
গত জুন মাসে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিমও গঠন করা হয়।
২৬ জুন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য একটি অনুসন্ধান টিম গঠনের প্রস্তাবসহ কমিশনের অনুমোদনের জন্য নথি উপস্থাপন করা হয়েছে। দুদক উপপরিচালক নারগিস সুলতানা ও সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমানের সমন্বয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ওই প্রজ্ঞাপনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ভুয়া দরপত্র, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দর দেওয়ার অনুরোধ-সংক্রান্ত (আরএফকিউ) দরপত্রে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ও একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতিবছর হাটবাজার ইজারার টাকা যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এছাড়া ভূমি দখল ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণ-সংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উল্লিখিত অভিযোগগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার, বিধিনিষেধের পরিপন্থি কার্যকলাপ, দুর্নীতি ও ইচ্ছাকৃত অপশাসনের শামিল, যা সিটি করপোরেশন আইনানুযায়ী অপসারণযোগ্য অপরাধ। এরই মধ্যে এসব অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার মাধ্যমে সিটি করপোরেশন অপসারণের কার্যক্রমও শুরু করেছে। সুষ্ঠু তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।
এর আগে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের কিছু বিতর্কিত মন্তব্য-সংবলিত ভিডিও ভাইরাল হওয়াার পর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ এবং ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে আজিবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
মন্তব্য করুন: